মৃত্তিকা ও সার ব্যবস্থাপনা
মটিতে উদ্ভিদের খাদ্য উপাদানের পরিমানের উপর উর্বরতা নিদের্শ করে। যে মাটিতে যত বেশী পরিমান খাদ্যপ্রান (খনিজ পদার্থ) মজুদ সে মাটি তত বেশী উর্বর। সময় যতই যেতে থাকে জমির উর্বরা শক্তি ততই কমতে থাকে। দেখা গেছে, উন্মুক্ত করার ২০-৩০ বছরে মধ্যেই আবাদী জমি এর ৩০-৪০% জৈব পদার্থ হারিয়ে ফেলে। সার প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারনের জন্য আবাদী জমির উর্বরতা অর্থাৎ জমিতে কি কি উপাদান কি পরিমান মজুদ তা মাটি বিশ্লেষন করে জেনে নিতে হবে।
পুষ্টিহীনতার লক্ষণ
নাইট্রোজেনের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
নতুন পাতা এবং কুঁড়ি হলদে রং ধারণ করে।
পাতার আকৃতি ছোট এবং কিশলয়ের আকৃতি ছোট হয়।
পাতা ও কিশল্পয়ের বৃদ্ধি ধীর/ব্যাহত হয়। ফলে উৎপাদন কমে যায়।
ফসফরাসের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
বয়স্ক পাতার রং সাধারণ সবুজের চেয়ে অতিরিক্ত গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং পাতার উজ্জলতা নষ্ট হয়।
পাতার আকৃতি ছোট এবং কিশলয় সরু হয়।
গাছের শেকড়ের সংখ্যা ও বৃদ্ধি স্বাভাবিকের চেয়ে কমে যায়।
পটাসিয়ামের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
কিশলয়ের অগ্রভাগ পুড়ে যায়।
পাতা ও কিশলয়ের নিচের দিকে হেলে যায়।
কিশলয় সরু ও শক্ত হয়ে যায়।
গাছের কার্বোহাইড্রেট তৈরির পরিমাণ কমে যায়।
ক্যালসিয়ামের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
পাতা নৌকাকৃতি হয়ে যায়।
কিশলয়ের অগ্রভাগ বাঁকা হয়ে যায়/ভেঙ্গে যায়।
দুটি পত্রকক্ষের মধ্যবর্তী দূরত্ব কমে যায়।
ম্যাগনেসিয়ামের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
প্রাপ্তবয়স্ক ও নিচের পাতার মাঝামাঝি শিরার দিকে ক্লোরোসিস দেখা যায়।
সালফারের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
নতুন পাতার রং হলুদ হয়ে যায়।
পাতার পার্শ বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, ফলে পাতা সরু হয়ে যায়।
জিংকের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
পাতার বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
কিশলয়ের অগ্রভাগ ‘রোসেটি’ গঠিত হয়।
পাতা কান্ডের মতো লম্বা ও সরু হয়।
পাতার আকৃতি অসম হয়।
কিশলয় বাঞ্জিতে পরিনত হয়।
পাতার কিনারা ডেউ খেলানো হয়ে যায়।
ম্যাঙ্গানিজের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
পাতার শিরার অন্তরবর্তী পত্রকলার রং হালকা সবুজ হয়ে যায় এবং পরে হলুদ রং ধারণ করে।
সবুজ শিরার সংখ্যা কমে যায়।
পাতায় লাল বাদামি রঙয়ের স্পট পড়ে।
লৌহের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
নতুন পাতায় ক্লোরোসিস দেখা যায়।
পাতার রং হালকা সবুজ হয়ে যায়।
বোরনের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
কিশলয়ের অগ্রভাগ পুড়ে যায় বা অগ্রভাগ হতে নিচের দিকে মরা শুরু হয়।
পাতা মোড়ানো, সরু এবং চামড়ার মতো শক্ত হয়ে যায়।
পাতা গাঢ় সবুজ বর্ণ ধারণ করে।
কপারের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
পাতা কালচে বর্ণ ধারণ করে।
ফার্মেন্টশন হতে সময় বেশি নেয়।
ফার্মেন্টশনের পর পাতার রং উজ্জ্বল বাদামি না হয়ে ধূসর বাদামি হয়।
ক্লোরিনের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
পাতা তামাটে রং ধারণ করে।
পাতায় wilt, chlorosis, necrosis দেখা দেয়।
মলিবডেনামের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
উদ্ভিদের বৃদ্ধি হ্রাস পায়।
পাতায় পচন দেখা দেয়।
পাতার আকার ছোট হয়ে যায়।
অ্যালুমিনিয়ামের ঘাটতিজনিত লক্ষণঃ
চা গাছের বৃদ্ধি হয় না।
সার সাধারনত দুই প্রকারঃ
১) জৈব সার ও
২) রাসায়নিক সার।
জৈব সারঃ জীব দেহ থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে প্রাপ্ত অথবা তৈরী সারকে জৈব সার বলে। গোবর, কম্পোট, খৈল, ছাই, সবুজ সার, হারের গুড়া, রক্ত ইত্যাদি।
রাসায়নিক সারঃ বিভিন্ন পদার্থ ব্যাবহার করে কারখানায় কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে সার তৈরী হয় তাকে রাসায়নিক সার বলে। যেমন- ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি ইত্যাদি রাসাযনিক সার।
এছাড়াও বর্তমানে জীবাণু সার বা বায়ো-ফার্টিলাইজার নামে এক ধরনের সার রয়েছে। যেমন- রাইজোবিয়াম, এজোস্পাইরেলিয়াম, ব্লু গ্রীন আলজি ইত্যাদি।
সার প্রয়োগের উদ্দেশ্যঃ
উদ্ভিদকে বাহির হতে খাদ্যোপাদান সরবরাহ করা।
বিদ্যমান খাদ্যোপাদানের অভাব হলে তা পূরণ করা।
পর্যাপ্ত খাদ্যোপাদানের পরিমাণ সব সময় চলমান রাখা।
অধিক উৎপাদন পাওয়ার জন্য।
ফসলের মান উন্নয়নের জন্য।
উদ্ভিদের সতেজ ও দ্রুত বৃদ্ধির জন্য।
সার প্রয়োগ সূপারিশমালাঃ
নার্সারীতে সার প্রয়োগ সূপারিশমালাঃ
প্রাথমিক বেডে প্রতি বর্গ মিটারে ১৫০ গ্রাম টিএসপি ও ১৫০ গ্রাম ডলোমাইট
সেকেন্ডারী বেডে প্রতি ঘন মিটারে ৩০০-৩৫০ গ্রাম টিএসপি ১৫০-২০০ গ্রাম ডলোমাইট
শেড সরানোর পর রোপনের জন্য রেডি চারা ২% ইউরিয়া ও এমওপি
গোবর পানির মিশ্রণঃ গোবর পানির অনুপাত ১:৪ ভাল করে পাত্রে মিশিয়ে ২-৩ সপ্তাহ রেখে পচাতে হবে (স্টক সলিউসন)। মোটা ছিদ্রযুক্ত ছাকনি দিয়ে ছাকতে হবে। স্টক সলিউশন পূনরায় পানির সাথে ১:৪ অনুপাতে মিশ্রণ তৈরী করে ১৫ দিন অন্তর ২ বার প্রয়োগ করা গেলে চারার বৃদ্ধি ভাল হবে।
৫০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম এম ও পি ১৫ লিটার পানিতে মিশ্রণ তৈরী করে ১০০০ চারায় ঝাজরির সাহায্যে প্রয়োগ করলে চারার বৃদ্ধি ভাল হয়।
নিউক্লিয়াস ক্লোন প্লটে সার প্রয়োগঃ
হেক্টর প্রতি ২:১:২ অনুপাতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাস (ইউরিয়া ২০০ কেজি টিএসপি ১০০ কেজি এবং এমওপি ২০০ কেজি)। বৎসরে দুই বার প্রয়োগ করতে হবে। তবে প্রথম দফায় সম্পূর্ণ টিএসপি সার দিয়ে দিতে হবে।
চারা রোপনের সময়ঃ
প্রতি চারার গর্তে ৩০ গ্রাম টিএসপি ও ২ কেজি গোবর/কম্পোস্ট সার গর্তের উপরিভাগের মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে।
ছায়াতরু রোপনের সময়ঃ
প্রতি গর্তে ১০-১৫ কেজি গোবর, ১-১.৫ কেজি খৈল ও ২০০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে। ১ কেজি ডলোমাইট ভাল করে মাটির সাথে মিশিয়ে রোপণের সময় পিন্ডির চারদিকে দিতে হবে।
বীজবাড়ীতে সার প্রয়োগঃ
প্রয়োগকালঃ প্রথম দফা মার্চ/এপ্রিল, যখন মাটির সাথে মিশে যাওয়া বা শোষণের জন্য পর্যাপ্ত আর্দ্রতা থাকে। দ্বিতীয় দফা জুলাই/আগস্ট মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক চা গাছে সার প্রয়োগ সূপারিশমালা (কেজি/একর)
উক্ত অনুপাতে সার মিশিয়ে ৩ দফায় (এক তৃতীয়াংশ করে) এপ্রিল/মে মাসে প্রথম, আগস্ট মাসে দ্বিতীয় ও অক্টোবর মাসে তৃতীয় দফা প্রয়োগ করতে হবে।
প্রাপ্ত বয়স্ক চা গাছে সার প্রয়োগ সূপারিশমালাঃ
প্রথম দফাঃ
প্রয়োগ মাত্রাঃ প্রতি একরে ৪০০ কেজি তৈরী চা উৎপাদন হলে ইউরিয়া-৫০ কেজি, টিএসপি-২৫ কেজি, এমওপি-৩০ কেজি। তবে প্রতি ১০০ কেজি অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য আরও ইউরিয়া-১২ কেজি, টিএসপি-৩ কেজি, এমওপি-৬ কেজি প্রয়োগ করতে হবে।
প্রয়োগের সময়ঃ মার্চ/ এপ্রিল মাসে যখন মাটিতে পর্যাপ্ত রসের সঞ্চয় হবে।
দ্বিতীয় দফাঃ
প্রয়োগ মাত্রাঃ ইউরিয়া-৫৫ কেজি, এমওপি-২৫ কেজি হারে প্রয়োগ করতে হবে।
প্রয়োগের সময়ঃ জুলাই মাসের শেষের দিকে বা আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে।
সারের কার্যকারীতা বৃদ্ধির জন্য করনীয়ঃ
উৎপাদনের উপর ভিত্তি করে সঠিক সার ও সঠিক পরিমান সার মিশ্রণ করতে হবে।
সঠিক সার প্রয়োগ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
সার প্রয়োগের সময় জমিতে পর্যাপ্ত রস থাকতে হবে।
সার মিশ্রণ তৈরীর পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাগানে প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগের পূর্বে বাগান আগাছা মুক্ত করতে হবে।
মাটির এসিডিটি সঠিক করে নিতে হবে।
সঠিক ভাবে ড্রেন করতে হবে যাতে জলাবদ্ধতা না হয়।
সূষম সার প্রয়োগ করতে হবে।
সঠিক সময়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
দফা ভিত্তিক সার দিতে হবে।
সার প্রয়োগের পূর্বে রোগ বালাই দমন করে নিতে হবে।
পাতায় যাতে সার না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সার প্রয়োগের সর্বশেষ সুপারিশমালাঃ
যত বেশী সম্ভব মাটিতে জৈব পদার্থ প্রয়োগ করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা করুন।
সূষম সার প্রয়োগ করুন।
সূষম সারে চা গাছে রোগ বালাই কম হয়।
সূষম সারে চায়ের গুনগত মাণ বৃদ্ধি করে।
সূষম সারে চায়ের উৎপাদন বাড়ে।
জৈব সারের কাজঃ
মাটির ভৌতিক ও রাসায়নিক গুনগত মান উন্নত করে।
গাছের শিকড় বেশী ভিতরে ঢুকতে পারে।
মাটিতে বসবাসকারী উপকারী পোকা মাকড় ও অনুজীবকে খাদ্য সরবরাহ করে।
শীত গ্রীস্মে মাটির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রন করে।
মাটি হতে রস শুকিয়ে যেতে বাধা দেয়।
পচে গাছের খাদ্য সরবরাহ করে।
ক্ষতিকর রাসায়নিক বিক্রিয়া ও বিষাক্ততা (বিষক্রিয়া) হতে উদ্ভিদকে রক্ষা করে।
জৈব এসিড সরবরাহ করে।
গাছের খাদ্য ভান্ডার হিসাবে কাজ করে।
ফসফরাসকে প্রাপ্তি যোগ্য করে।
জৈব পদার্থ পাওয়ার উপায়ঃ সবুজ সার, প্রুনিং লিটার, খড়কুটা, কম্পোস্ট, মালচ বাড়ি প্রতিষ্ঠা, গোবর, কচুরিপানা, খৈল ও হাড়ের গুড়া ইত্যাদি সহ যে কোন প্রকার উদ্ভিদ বা প্রাণীদেহের অবশিষ্টাংশ এবং ছায়াতরু হতে পতিত পত্রপল্লব।
জৈব পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধিঃ যদি বৎসরে প্রতি একরে ১,০০০ কেজি (১ টন) করে ১০ বৎসরে ১০,০০০ কেজি (১০ টন) শুকনো জৈব পদার্থ মিশ্রিত করা হয় এবং এ জৈব পদার্থ কোন প্রকারে ক্ষয় না হয় তবে মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১% বৃদ্ধি পায়।
ফলিয়ার প্রয়োগঃ
মাটিতে সার প্রয়োগের পাশাপাশি অধিক উৎপাদনের লক্ষে পাতায় স্প্রে করে সার প্রয়োগ করা যেতে পারে। গৌণ উপাদানের বেলায় মাটিতে প্রয়োগ না করে পাতায় স্প্রে করাই উত্তম। এতে অল্প সময়ে ভাল ফল পাওয়া যায়। চা বাগানে সাধারণত ইউরিয়া, ইউরিয়া+এমওপি, জিংক সালফেট, জিংক সালফেট+এমওপি, ডিএপি, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, ম্যাংগানিজ, বোরন ইত্যাদি ফলিয়ার স্প্রে করা হয়।
ইউরিয়াঃ ৪ কেজি ইউরিয়া ২০০ লিটার পানিতে গুলিয়ে এক হেক্টর জমিতে বছরে ২-৩ বার (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বা অক্টোবর-নভেম্বর) দেয়া যেতে পারে।
ইউরিয়া+এমওপিঃ প্রতিটি সার ২ কেজি করে মোট ৪ কেজি ২০০ লিটার পানিতে মিশ্রণ তৈরি করে এক হেক্টর জমিতে এক মাস অন্তর ২/৩ বার সিঞ্চন করা যেতে পারে।
জিংক সালফেটঃ ১-২ কেজি সার ২০০ লিটার পানিতে মিশ্রণ তৈরি করে এক হেক্টর জমিতে এক মাস অন্তর বছরে ২ বার সিঞ্চন করা যেতে পারে।
জিংক সালফেট+এমওপিঃ প্রতিটি সার ১ কেজি করে মোট ২ কেজি ২০০ লিটার পানিতে মিশ্রণ তৈরি করে এক হেক্টর জমিতে এক মাস অন্তর বছরে ২ বার প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ডিএপিঃ ৪ কেজি ২০০ লিটার পানিতে মিশ্রণ তৈরি করে এক হেক্টর জমিতে এক মাস অন্তর বৎসরে ২/৩ বার সিঞ্চন করা যেতে পারে।
ম্যাগনেসিয়াম সালফেটঃ ২ কেজি ২০০ লিটার পানিতে মিশ্রণ তৈরি করে এক হেক্টর জমিতে এক মাস অন্তর বৎসরে ২/৩ বার সিঞ্চন করা যেতে পারে।
ম্যাংগানিজঃ ২ কেজি ২০০ লিটার পানিতে মিশ্রণ তৈরি করে এক হেক্টর জমিতে এক মাস অন্তর বৎসরে ২/৩ বার সিঞ্চন করা যেতে পারে।
বোরনঃ ২ কেজি ২০০ লিটার পানিতে মিশ্রণ তৈরি করে এক হেক্টর জমিতে এক মাস অন্তর বৎসরে ২/৩ বার সিঞ্চন করা যেতে পারে।