দেশে এবারের মৌসুমে মোট ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এর ১৫ শতাংশই হয়েছে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলায়। সিলেট ও চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের পর সর্ব-উত্তরের পাঁচ জেলা দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বদৌলতে চা উৎপাদনে এসব জেলায় একের পর এক রেকর্ড করে চলেছে। সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে (২০২১) পাঁচ জেলার সমতল ভূমিতে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের মৌসুমের চেয়ে ৪২ লাখ ৪০ হাজার কেজি বেশি, আর জাতীয় উৎপাদনের ১৫ শতাংশ। চা উৎপাদনের জন্য নতুন করে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠা জেলাগুলো হচ্ছে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট।
বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এবারের মৌসুমে সারা দেশে মোট ৯ কোটি ৬৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা (মেড টি বা তৈরি চা) উৎপাদিত হয়েছে। বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলের সমতল ভূমিতে ২০১৭ সালে ৫৪ লাখ ৪৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। পরবর্তী বছরগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে ৮৪ লাখ ৬৭ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে ৯৫ লাখ ৯৯ হাজার কেজি, ২০২০ সালে ১ কোটি ৩ লাখ কেজি ও সর্বশেষ ২০২১ সালে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে।
পঞ্চগড় ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সমতল ভূমি চা চাষের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়।
মোহাম্মদ শামীম আল মামুন চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা
খাতসংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর পঞ্চগড় সফরে এসে সমতল ভূমিতে চা চাষের সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছিলেন। সে অনুযায়ী পঞ্চগড়ের তৎকালীন জেলা প্রশাসক রবিউল ইসলামের চেষ্টায় স্বল্প পরিসরে পরীক্ষামূলকভাবে পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ শুরু হয়। তবে প্রথম দিকে টবে, পরে পতিত জমিতে বাড়তে থাকে চা চাষ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০০ সালে বেশ কয়েকটি কোম্পানি পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চায়ের বাগান গড়ে তোলে।
অবশেষে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে এসে বাংলাদেশ চা বোর্ড ‘নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্প’ হাতে নেয়। উত্তরাঞ্চলে চায়ের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নেওয়া এই প্রকল্প ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত চলে। এর আওতায় করোনাকালেও চা-চাষিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখাসহ ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলের’ মাধ্যমে চায়ের আবাদ সম্পর্কে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হয়। সেই সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তি ও স্বল্প মূল্যে উচ্চফলনশীল চারা সরবরাহ করা হয়।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এই জেলার পর ২০০৭ সালে লালমনিরহাট ও ঠাকুরগাঁও এবং ২০১৪ সালে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলায় চা চাষ শুরু হয়। উত্তরাঞ্চলের এই ৫ জেলায় বর্তমানে নিবন্ধিত ৯টি ও অনিবন্ধিত ২১টি বড় চা-বাগান (২৫ একরের ওপরে) রয়েছে। এ ছাড়া ১ হাজার ৭৪৫টি নিবন্ধিত ও ৮ হাজার ৬৭টি অনিবন্ধিত ক্ষুদ্রায়তনের চা-বাগান (২৫ একরের কম) আছে। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে প্রায় ১১ হাজার ৪৩৪ একর জমিতে চা হচ্ছে।
চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত ৪১টি চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা লাইসেন্স নিয়েছে। এর মধ্যে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলায় ২২টি কারখানা চালু রয়েছে। এই কারখানাগুলো চা-চাষিদের কাছ থেকে সবুজ চা-পাতা কিনে তা থেকে চা তৈরি (মেড টি) করে। এরপর সেই চা চট্টগ্রাম ও শ্রীমঙ্গলের নিলাম বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানার মালিকেরা।
চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শামীম আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পঞ্চগড় ও এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর সমতল ভূমি চা চাষের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। সে জন্য আমরা চাষিদের বিভিন্ন সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে চা চাষে উদ্বুদ্ধ করছি। এর আগে ২০১৫-২০২১ সাল পর্যন্ত আমরা চা বোর্ডের “নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্প” সফলভাবে সম্পন্ন করেছি।’
শামীম আল মামুন জানান, বিভিন্ন এলাকায় ‘ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল’-এ হাতে-কলমে চা চাষের কলাকৌশল শেখানোর পাশাপাশি চাষিদের বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সমাধানে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ নামে একটি মোবাইল অ্যাপস চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ে একটি পেস্ট ম্যানেজমেন্ট ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে, যেখানে চা-বাগানে রোগবালাই ও পোকা দমনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সহায়তা দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, কাঁচা পাতার ন্যায্যমূল্য মিলছে। সে জন্য নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও চাষিরা চা চাষে উৎসাহিত হচ্ছেন।