বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর দেশের উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে পঞ্চগড় অন্যতম চা অঞ্চল হিসেবে এরই মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। দেশের উত্তর জনপদের পঞ্চগড়ে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি ও দেশের সবচেয়ে অনুন্নত জেলা এখন চায়ের সবুজ পাতায় ভরে গেছে। সৃষ্টি হয়েছে চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য। হিমালয় কন্যা খ্যাত সবুজ শ্যামলে ঘেরা দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে চা চাষ শুরুর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তার ফসল আজকের পঞ্চগড়ের চা বাগান। ক্ষুদ্র পরিসরে চা চাষের পথিকৃত জেলা পঞ্চগড়। ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে চা চাষের যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে হাটি হাটি পা পা করে পঞ্চগড়ের চা আজ ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছে। পঞ্চগড়ে চা চাষের যে বিপ্লব ঘটেছে তা মূলত বাংলাদেশ চা বোর্ড তথা বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিটিআরআই) এ নিয়োজিত বিজ্ঞানীবৃন্দ ও প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের কর্মকর্তাদের নিরলস কর্ম প্রচেষ্টায়। যার ফলে বাংলাদেশের সর্ব উত্তরের এই অবহেলিত অঞ্চল মঙ্গা নামক অভিশাপ্ত শব্দটিকে জয় করতে পেরেছে। এতে করে এই উত্তরের জনপদটি যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মকাণ্ডে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে তেমনি এই অঞ্চলটি অর্থনৈতিকভাবে অন্যতম চালিকা শক্তিতেও রূপান্তরিত হয়েছে। এক্ষেত্রে চা শিল্প নিঃসন্দেহে অগ্রণী ভুমিকা রেখে আসছে।
বর্তমানে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ৯টি নিবন্ধিত ও ১৮টি অনিবন্ধিত চা বাগান এবং ৬,৫৫৮টি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানে মোট ৮৬৮০ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। বিগর বছরে এ অঞ্চল থকে ৯.৬ মিলিয়ন কেজি (দেশের ১০ শতাংশ) চা উৎপাদিত হয়েছে। শুরুতে এ অঞ্চলের বেশীরভাগ ক্ষুদ্র চা চাষিগণ চা চাষে অনভিজ্ঞ ছিল। তাই অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতার কারণে তাঁরা তাঁদের ইচ্ছামতো চারা রোপন, পাতা চয়ন, প্রুনিং, সার প্রয়োগ ও পোকামাকড় দমন করে থাকতো। ফলশ্রুতিতে প্রায়শই তাঁদের চা বাগানে ভুল প্র্যাকটিস অনুসরণ করতে দেখা যায়। উল্লেখ্য উত্তরাঞ্চলের ক্ষুদ্রায়তন চা চাষিদের বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় কার্যালয় থেকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা জারী ছিল। তবে বর্তমান চেয়ারম্যান হাতে কলমে প্রশিক্ষণের বিষয়টি অধিকতর নিয়মতান্ত্রিক করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যাতে করে সকল স্তরের অর্থাৎ ১৪৮২ জন নিবন্ধিত ও ৫০৭৬ জন অনিবন্ধিত ক্ষুদ্র চা চাষিদের দোরগোড়ায় প্রশিক্ষণ সেবা সারা বছর জুড়ে বিরাজমান থাকে।
এ প্রেক্ষিতে গত ২০ অক্টোবর ২০২০ খ্রি. তারিখে বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মোঃ জহিরুল ইসলাম এনডিসি, পিএসসি মহোদয় পঞ্চগড়ে সফরকালীন উত্তরবঙ্গের চা শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত অংশীজনদের সাথে মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণসহ বটলিফ চা কারখানা ও ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালীন ক্ষুদ্র চাষিদের সাথে আলোচনাকালে চাষিরা চা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্ন ও অজানা বিষয় সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করেন। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান কৃষকের চা সম্পর্কে এ ধরণের গুরুত্বপুর্ণ অজানা বিষয়গুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্কুলের মাধ্যমে সহজে শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাঁরই চিন্তার ফসল “ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল”।
এ প্রেক্ষিতে কৃষকের দোরগোড়ায় বর্ণিত সেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে “ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল” নামে একটি দেয়াল ও ছাদ বিহীন স্কুল চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। তাৎক্ষনিকভাবে বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন “এক্সটেনশন অব স্মল হোল্ডিং টি কালটিভেশন ইন নর্দান বাংলাদেশ” প্রকল্পের পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুনকে ইউনিয়ন ভিত্তিক “ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল” বাস্তবায়নের নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই থেকে কৃষকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বিগত ২৫ অক্টোবর ২০২০ খ্রি. তারিখে পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলায় চালু হলো “ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল”। যা প্রতিমাসেই বিভিন্ন ইউনিয়ন পর্যায়ে চলমান থাকবে। উল্লেখ্য যে, “ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল” এর কার্যক্রম একই সাথে লালমনিরহাট, পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবানসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর ও জামালপুরে শুরু হয়েছে।
“ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুল” নামকরণের যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। চায়ের উদ্ভিদতাত্তিক বা বৈজ্ঞানিক নাম হলো “ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস”। সেই নাম থেকে জেনাস অংশটুকু নিয়ে ‘ক্যামেলিয়া’ এবং দেয়াল ও ছাদ বিহীন স্কুলের নামে ‘খোলা আকাশ স্কুল’ বা “Camellia Open Sky School” নামকরণ করা হয়েছে। এটি কোন কাব্যিক বা সাহিত্যিক নাম নয়। এটি কৃষকের চা সম্পর্কিত অজানা তথ্য জানার জন্য একটি স্কুল। এটি গতানুগতিক কোন স্কুল বা পাঠশালা নয়। এটি চা বাগানের পাশে খোলা ময়দানে খোলা আকশের নিচে ৪০-৫০ জন ক্ষুদ্র চা চাষিদের নিয়ে আয়োজিত একটি ছাদ ও দেয়াল বিহীন স্কুল। এ স্কুলে চায়ের জাত নির্বাচন, নার্সারী তৈরি, চারা রোপন, পাতা চয়ন, প্রুনিং, সেচ ও পানি নিষ্কাশন, সার প্রয়োগ ও পোকামাকড়-রোগবালাই দমন ইত্যাদি সম্পর্কে ক্ষুদ্র চাষিদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। উল্লেখ্য হাতেকলমে প্রশিক্ষণের জন্য ক্ষুদ্রায়তন চা চাষিদের নিজস্ব বাগানের আঙ্গিনা সবচেয়ে কার্যকরী ও উপযুক্ত স্থান।
ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ ফ্রেমের স্কুলটি চা বাগান সংলগ্ন অংশের স্থানটিকেই নির্বাচন করে থাকে প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য। যাতে করে কৃষকদের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয় কিংবা অফিসে আসতে না হয়। ছাদ বিহীন এ স্কুল পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ড অনেক ক্ষেত্রে পঞ্চগড়, লালমনিরহাট ও বান্দরবানের অফিস স্থানীয় চাষিদের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত বেশী সাফল্য অর্জনকারী চাষিদের উক্ত স্কুল পরিচালনার জন্য উদ্বুদ্ধ করে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে কয়েকটি বাগান নিয়ে ক্লাষ্টার করেও প্রশিক্ষণ পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
উদ্দেশ্যঃ
• এ স্কুলের মাধ্যমে উত্তরাঞ্চলে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের ক্ষুদ্র চা চাষিদের হাতেকলমে প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
• কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী চা পিয়াসু মনের খোরাক মিটাতে চা আবাদীর বিভিন্ন বিষয়ে সহজভাবে জ্ঞান দান করা।
• চাষিদের চা আবাদীর বিভিন্ন সমস্যা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে তার সুষ্ঠু সমাধান দেওয়া।
• চা আবাদীর বিভিন্ন মডিউলে সিলেবাস ভিত্তিক চাষিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া।
• চায়ের তাত্ত্বিক ক্লাসের পাশাপাশি চা বাগানের মধ্যে ব্যবহারিক ক্লাস নেওয়া ও ত্রুটি বিচ্যুতি সংশোধন করা।
• প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্য থেকে উপযুক্ত প্রশিক্ষক নির্বাচন করা যাতে পরবর্তীতে তাঁরা “ক্যামেলিয়া খোলা আকাশ স্কুলে” ক্লাস নিতে পারে।
• গুণগতমান সম্পন্ন চা তৈরির লক্ষ্যে টি টেস্টিং সেশনের আয়োজন করা।
কার্যাবলীঃ
• চাষিদের গ্রহণ উপযোগী সিলেবাস তৈরিকরণ ও প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল বিতরণ।
• বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে চাষিদের ক্লাস পরিচালনা করা।
• প্রশিক্ষণার্থীদের ক্লাস শেষে মূল্যায়ন করা।
• মাল্টিমিডিয়াতে চা আবাদীর বিভিন্ন বিষয়ের ভিডিও দেখানো।
• ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ মোবাইল অ্যাপ্স এর ব্যবহার শিখানো।
• অর্গানিক পদ্ধতিতে চা চাষ করার পরামর্শ প্রদান।
• ক্ষেত্র বিশেষ বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) থেকে অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট (পিডিইউ) থেকে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক নিয়োগ করে উন্নতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কাঙ্ক্ষিত ফলাফলঃ
• দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চা চাষি তৈরি।
• সঠিক উপায়ে ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চা আবাদী ব্যবস্থপনা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ ও প্রয়োগ।
• উত্তরাঞ্চলে চা আবাদীর বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল গ্রহণ।
• টেকসই ও নিরাপদ চা উৎপাদন এবং চাষিদের কাঁচা পাতা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি।
• কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে সক্ষম।
• উত্তরাঞ্চলে কম খরচে চায়ের উৎপাদন ও গুণগতমান বৃদ্ধি।